সোমবার, ২০ মে, ২০১৩

বিশ্বের মুসলিম উম্মাহ’র সকল ইবাদত একই দিনে (৪র্থ)


বিশ্বের মুসলিম উম্মাহ’র সকল ইবাদত একই দিনে (৪র্থ)

 

১ম অংশ- http://sottersondhane.blogspot.com/2012/11/blog-post.html (pls click & read)
১ম অংশে পাবেন- নামায কিভাবে একই দিনে হয় ? এর কিছু দলিল ।

২য় অংশ- http://sottersondhane.blogspot.com/2012/11/blog-post_5.html (pls click & read)
২য় অংশে চাঁদ দেখার স্বাক্ষী কয়জন, কোথাকার তার দলিল পাবেন ।

৩য় অংশে বিশ্বে চাঁদ দেখার বিভিন্নতা এবং একই ইবাদতের দিন দেশ অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন হয় । এর কিছু তথ্য পাবেন ।

আমরা অনেকে মাযহাবের (ফেকাহ শাস্ত্রের) অনুসরণ করি । ফেকাহ শাস্ত্র খুলে দেখুন তাদের কি মত ছিলঃ-

(১) আলোচিত বিষয়ে বিশ্ব বিখ্যাত ফিকহ গ্রন্থ ফাতওয়া-ই-শামী-এর সিদ্ধান্ত হচ্ছে-

ভৌগলিক কারণে চন্দ্রমাসের ১ তারিখের চাঁদ কখনই প্রথম দিন সারা পৃথিবী থেকে দেখা যায় না । বরং সমগ্র পৃথিবীতে নুতন চাঁদ দেখা যেতে ২ থেকে ৩ দিন সময় লেগে যায় । এখন প্রশ্ন হল প্রথম দিন ভূ-পৃষ্ঠের যে সব দেশে নুতন চাঁদ দেখা গেল ঐ সব দেশে চন্দ্র মাসের ১ তারিখ, আবার ২য় দিন যেসব দেশে চাঁদ দেখা গেল সে সব দেশে নুতন করে ২য় ১ তারিখ, আবার ৩য় দিন যেসব দেশে চাঁদ দেখা গেল সেসব দেশে নুতন ৩য় ১ তারিখ গণনা করা হবে ? অর্থাৎ নুতন চাঁদ দেখার বিভিন্নতায় একই চান্দ্রমাসের ভিন্ন ভিন্ন তিনটি ১ তারিখ হবে ? নাকি প্রথম দিনের দেখার ভিত্তিতেই সমগ্র পৃথিবীতে বিশ্ব জনীন (Universal) একটি তারিখ গণনা হবে ? যাকে ফিকহের পরিভাষায়- اختلاف المطالع معتبر ام لا অর্থাৎ চাঁদের উদয়স্থলের ভিন্নতা গ্রহণীয় হবে কিনা ?

এ ব্যাপারে মতানৈক্য রয়েছে । এ ভাবে যে, প্রত্যেক দেশের মানুষ নিজ নিজ দেখার ভিত্তিতে আমল করবে ? না কি উদয়স্থলের ভিন্নতা গ্রহণযোগ্য হবে না বরং সর্ব প্রথম চাঁদ দেখার ভিত্তিতে সকলের জন্য আমল করা জরুরী হবে ? এমনকি প্রাচ্যে যদি জুমার রাতে চাঁদ দেখা যায় আর পাশ্চাত্যে শনিবার রাতে চাঁদ দেখা যায় তবে পাশ্চাত্যের অধিবাসীদের উপর প্রাচ্যের দেখা অনুযায়ী আমল করা ওয়াজিব ? এ বিষয়ে কেউ কেউ প্রথম মতটি গ্রহণ করেছেন (অর্থাৎ এক দেশের চাঁদ দেখা অন্য দেশের মানুষের জন্য গ্রহনীয় নয়) । ইমাম যায়লায়ী ও ফয়েজ গ্রন্থের প্রণেতা এ মতটি গ্রহণ করেছেন । শাফেয়ী মাযহাবের মতও এটা । তাদের যুক্তি হল চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে প্রত্যেক দেশীয় লোক নামাযের ওয়াক্তের মতই নিজ এলাকা বিশেষে সম্বোধিত । যেমন যে অঞ্চলে এশা ও বিতরের ওয়াক্ত হয়না সেখানে এশা ও বিতর নামায আদায় করতে হয়না ।

আর সুপ্রতিষ্ঠিত মত হচ্ছে দ্বিতীয়টি অর্থাৎ চাঁদ দেখার ভিন্নতা গ্রহনীয় নয় । বরং প্রথম দিনের দেখার দ্বারাই সমগ্র পৃথিবীতে এক কেন্দ্রিক তারিখ গণনা করে, একই দিনে একই তারিখে আমল করতে হবে । এটাই আমাদের হানাফী মাযহাবের সিদ্ধান্ত । মালেকী এবং হাম্বলী মাযহাবের মতও এটা । তাদের দলীল হচ্ছে আয়াত ও হাদীসে চাঁদ দেখার সম্বোধন সকলের জন্য আম বা সার্বজনীন যা নামাজের ওয়াক্তের সম্বোধন থেকে আলাদা-(ফাতওয়া-ই-শামী, খন্ড-২, পৃঃ-১০৫)

(২) বিশ্ব বিখ্যাত ও সর্বজন গ্রহণযোগ্য কিতাব ফাতওয়া-ই-আলমগীরির সিদ্ধান্ত হলো-

অর্থাৎ ফিকহের প্রতিষ্ঠিত বর্ণনানুযায়ী চাঁদ ঊদয়ের বিভিন্নতা গ্রহণীয় নয় । ফতুয়াই কাযী খানের ফাতওয়াও অনুরুপ । ফকীহ আবু লাইছও এমনটাই বলেছেন । শামছুল আইম্মা হোলওয়ানী সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে, যদি পাশ্চাত্যবাসী রমযানের চাঁদ দেখে তবে সে দেখার দ্বারা প্রাচ্য বাসীর জন্য রোযা ওয়াজিব হবে । এমনটাই আছে খোলাছা নামক কিতাবে-(ফাতওয়া-ই- আলমগিরী, খন্ড-১, পৃঃ-১৯৮)

(৩) চার মাযহাবের সমন্বিত ফিকহ গ্রন্থ আল ফিকহ আলা মাযাহিবিল আরবায়া নামক গ্রন্থের ভাষ্য হচ্ছে-

অর্থাৎ পৃথিবীর কোন এক প্রান্তে চাঁদ দেখা প্রমাণিত হলে সকল স্থানেই উক্ত দেখার দ্বারা রোযা ফরয হবে ।
চাই চাঁদ নিকটবর্তী দেশে দেখা যাক বা দূরবর্তী দেশে দেখা যাক এতে কোন পার্থক্য নেই । তবে চাঁদ দেখার সংবাদ গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে অন্যদের নিকট পৌছতে হবে । তিন ইমাম তথা ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি,ইমাম মালেক রহমাতুল্লাহি আলাইহি এবং ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বল রহমাতুল্লাহি আলাইহি-এর মতে চাঁদের উদয়স্থলের ভিন্নতা গ্রহণীয় নয় । অর্থাৎ প্রথম দিনের দেখার দ্বারাই সর্বত্র আমল ফরয হয়ে যাবে(আল ফিকহ আলা মাযাহিবিল আরবায়া, খন্ড-১, পৃঃ-৪৪৩)

(৪) বিশ্ব মানের ফিকহ গ্রন্থ আল ফিকহুস্‌ সুন্নাহ এর সিদ্ধান্ত হচ্ছে-

অর্থাৎ জমহুর ফুকাহা গনের সিদ্ধান্ত অতএব যখনই কোন দেশে চাঁদ দেখা প্রমাণিত হবে তখনই অন্য সকল দেশে রোযা ফরয হয়ে যাবে । কেননা রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম এরশাদ করেছেন “চাঁদ দেখার প্রমাণ সাপেক্ষে তোমরা রোযা রাখ এবং চাঁদ দেখার প্রমাণ সাপেক্ষে তোমরা রোযা ছাড়, ঈদ কর”। এখানে তোমরা বলে সম্বোধন দেশ মহাদেশ নির্বিশেষে সকল উম্মতের জন্য عام ব্যাপক অর্থবোধক । অতএব উম্মতের মধ্য থেকে যে কেউ যে কোন স্থান থেকে চাঁদ দেখুক উক্ত দেখাই সকল উম্মতের জন্য দলীল হবে । এ মত পোষণ করেছেন হযরত ইকরামা, কাসেম ইবনে মুহাম্মাদ, সালেম এবং ইসহাক রহমাতুল্লাহি আলাইহিম । হানাফী ফকীহগণের এটাই বিশুদ্ধমত- (আল-ফিকহুস্‌ সুন্নাহ, খন্ড-১, পৃঃ-৩০৭)

(৫) বিশ্ব বিখ্যাত ফিকহ্‌ গ্রন্থ “মুগনী”-এর সিদ্ধান্ত হচ্ছে-

অর্থাৎ কোন এক দেশের মানুষ চাঁদ দেখলে সকল দেশের মানুষের জন্যে রোযা রাখা জরুরী হবে । চাই সে দেশ কাছে বা দূরে হোক, আর যে চাঁদ দেখেনি সে শরীয়তের দৃষ্টিতে তারই মত আমল করবে যে দেখেছে । চাঁদ উদয়ের স্থান ও কাল ভিন্ন হোক (তাতে পার্থক্য নেই)(আল-মুগনী, খন্ড-৪, পৃঃ-১২২)

(৬) বিশ্ব বিখ্যাত গ্রন্থ “তাবয়ীনুল হাকায়েক”-এর ভাষ্য হচ্ছে-

অর্থাৎ অত্র গ্রন্থের প্রণেতা (রঃ) বলছেন যে, চাঁদের উদয় স্থলের ভিন্নতা গ্রহণীয় নয় । যদিও কেউ চাঁদের উদয় স্থলের ভিন্নতা গ্রহণীয় হবে বলে মত প্রকাশ করেছেন । “ভিন্নতা গ্রহণীয় নয়” এর অর্থ হচ্ছে যদি এক দেশের অধিবাসীরা নুতন চাঁদ দেখেন এবং অন্য দেশের অধিবাসীরা না দেখেন তবে প্রথম দেশবাসীর দেখা দ্বারাই অন্য দেশবাসীদের জন্য রোযা রাখা ফরয হবে । অধিকাংশ মাশাইখ-ই এমত পোষণ করেছেন । এমনকি এক দেশের মানুষ ৩০টি রোযা রাখল, অন্য দেশের মানুষ রোযা রাখল ২৯টি, তাহলে অন্যদেরকে একটি রোযা কাযা করতে হবে ।
(তাবয়ীনুল হাকায়েক, খন্ড-২, পৃঃ-১৬৪/১৬৫)

(৭) বিশ্ব বিখ্যাত ও সর্বজন বিধিত ফিকহ্‌ গ্রন্থ “ফতহুল কাদির”-এর ভাষ্য হচ্ছে-

অর্থাৎ যখন কোন শহরে চাঁদ দেখা প্রমাণিত হবে, তখন সকল মানুষের উপর রোযা রাখা ফরয হবে । ফিকহের প্রতিষ্ঠিত মাযহাব অনুযায়ী পাশ্চাত্য বাসীর চাঁদ দেখার দ্বারা প্রাচ্য বাসীর জন্য রোযা রাখা ফরয হবে (ফতহুল কাদির, খন্ড-২, পৃঃ-৩১৮)

(৮) ফিকহের বিশ্ব বিখ্যাত গ্রন্থ ”বাহরুর রায়েক”-এর ভাষ্য হচ্ছে-

অর্থাৎ চাঁদের উদয় স্থলের ভিন্নতা গ্রহণীয় নয় । অতএব যখন এক দেশের মানুষ চাঁদ  দেখবে, তখন অন্য দেশের মানুষের জন্য রোযা রাখা ফরয হবে, যদিও তারা চাঁদ দেখেনি । যদি তাদের নিকট গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে চাঁদ দেখার সংবাদ পৌঁছে যায় । অতএব পাশ্চাত্যবাসীর দেখার দ্বারা প্রাচ্যবাসীর জন্য রোযা রাখা অত্যাবশ্যক হবে । যদিও কেউ কেউ বলেন উদয় স্থলের বিভিন্নতা গ্রহণযোগ্য । একের দেখা অন্যের জন্য প্রযোজ্য নয় । তবে ফিকহের প্রতিষ্ঠিত সিদ্ধান্ত হচ্ছে প্রথমটি । এমনটাই লেখা হয়েছে ফতহুল কাদির গ্রন্থে । সেখানে বলা হয়েছে এটাই প্রকাশ্য মাযহাব এবং এর উপরই ফাতওয়া। খোলাছা নামক কিতাবের ভাষ্যও তাই(বাহরুর রায়েক, খন্ড-২, পৃঃ-৪৭১)

(৯) “ফাতওয়া-ই-কাযীখান”-এর ভাষ্য হচ্ছে-

অর্থাৎ ফিক্‌হের সুপ্রতিষ্ঠিত মতানুসারে চাঁদের উদয় স্থলের ভিন্নতা গ্রহণীয় নয় । শামসুল উলামা হোলওয়ানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এমতই উল্লেখ করেছেন (কাযীখান, খন্ড-১, পৃঃ-৯৫)

(১০) বিশ্ব বিখ্যাত গ্রন্থ “হাশিয়া-ই-তাহতাবী” শরীফের ভাষ্য হচ্ছে-

অর্থাৎ ঈদুল আযহাসহ সকল মাসের চাঁদের হুকুম শাওয়ালের চাঁদের হুকুমের মতোই । কোন উদয় স্থলে চাঁদ দেখা গেলে দুনিয়ার সকল স্থানের মানুষের উপরই আমল জরুরী হবে । যদি চাঁদ উদয়ের সংবাদ পৌঁছে দুইজন সাক্ষীর সাক্ষ্যে, অথবা কাযীর ফয়সালার উপরে দুইজন সাক্ষ্য দেন, অথবা উদয়ের সংবাদটি ব্যাপক প্রসিদ্ধি লাভ করে-(হাশিয়া-ই-তাহতাবী শরীফ, পৃঃ-৩৫৯)

(১১) “মায়ারিফুস্‌ সুনান”-এর ভাষ্য হচ্ছে-

অর্থাৎ আমাদের মাযহাবের কিতাব সমূহের উপর ভিত্তি করে আমরা লিখেছি যে, এক দেশের চাঁদ দেখা অন্য দেশে গ্রহণীয় হবে । যদিও দেশ দুটির মধ্যে মাগরিব ও মাশরিকের দূরত্ব হয় । আর এ মাসয়ালা ফকীহ্‌গণের এ নীতিমালার উপর ভিত্তি করে যে চাঁদ উদয়স্থলের ভিন্নতা গ্রহণীয় হবে না । তবে ফকিহগণ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে, নামায ও ইফতারের ওয়াক্ত সমূহের ভিন্নতা গ্রহণীয় হবে এবং যার যার স্থানীয় সময় অনুযায়ী নামায পড়বে ও ইফতার করবে- (মায়ারিফুস্‌ সুনান, খন্ড-৫, পৃঃ-৩৩৭)


(১৩) ইমাম জাফর সাদেক রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-

অর্থাৎ রোযা রাখবে না যতক্ষণ না চাঁদ দেখবে, যদি অন্য শহর বা দেশবাসী চাঁদ দেখার সাক্ষী দেয় তাহলে ঐ দিনের রোযা কাযা করবে ।

(১৪) ফাতওয়ায়ে ইবনু তাইমিয়্যা গ্রন্থের ফাতওয়া হচ্ছে-

অর্থাৎ নব চাঁদ উদিত হওয়ার সংবাদ যতটুকু পৌঁছবে ততটুকু তার আওতাভূক্ত হবে । তা কিছুতেই দূরত্বের কারণে কোন দেশ, মহাদেশ বা অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকবে না ।                      (ফাতওয়ায়ে ইবনু তাইমিয়্যা, খন্ড-২৫, পৃঃ-১০৭)

কুরআন, হাদীস ও সম্মানিত ফকিহগণের সম্মিলিত ফাতওয়া সম্পর্কে উপমহাদেশের যুগ বরেণ্য আলেমগণের সিদ্ধান্তঃ-

(চলবে) 


৫ম অংশে প্রথম চাঁদ কোনটা গ্রহনযোগ্য এ নিয়ে উল্লেখযোগ্য আলেমেদ্বীন্দের কিছু ফতোয়া ও দলিল পাবেন । 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন