যাকাতের নিয়ম কানুন
ধন-সম্পদের যে নির্ধারিত অংশ শরীয়াতের বিধান
মোতাবেক আল্লাহর পথে ব্যয় করা মানুষের উপর
ফরজ করা হয়েছে তাকেই যাকাত বলে
(ইসলামী বিশ্বকোষ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২১ খন্ড ৪৭৫ পৃঃ) ।
প্রত্যেক সামর্থবান
মুসলিমের জন্য যাকাত হচ্ছে একান্ত কর্তব্য ও ফরজ
। সমাজের ধনী ও সচ্ছল লোকদের বাড়তি
সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ নিয়মিত আদায় করে দরিদ্র ও বঞ্চিত লোকদের মধ্যে যথাযথ বন্টন করাই কর্মসুচির প্রধান
বৈশিষ্ট্য । এ যাকাতের কথা পবিত্র কুআনে কোন কোন মতে ৩২ বার এবং অধিকাংশের মতে ৮২
বার উল্লেখ রয়েছে ।
পবিত্র কুরআন বলে-তোমাদের বন্ধুতো একমাত্র আল্লাহ তাঁর রাসুল এবং মুমিন বান্দা যারা
নামায কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং
বিনম্র (সুরা মায়েদার আয়াত ৫৫)
যাকাত আদিকাল থেকেই প্রচলিত ছিল
কারূনের ধ্বংস এসেছিল যাকাত প্রদান না করে কার্পণ্য করার কারণে,
ইয়াহুদী বণী ইসরাঈল হতে গৃহিত প্রতিশ্রুতিতে মহান
আল্লাহ বলেনঃ
তোমরা সালাত কায়েম
করবে এবং যাকাত দিবে (সুরা বাকারা
আয়াত ১১০);
পবিত্র কুরআনে
এসেছে ঈসা (আঃ) বলেন-
তিনি আমাকে আজীবন সালাত ও যাকাতের নির্দেশ দিয়েছেন (সুরা মারইয়াম আয়াত ১৩);
ইসমাঈল (আঃ) সম্পর্কে বলা হয়েছে-
তিনি তার পরিবার পরিজনদের সালাত ও যাকাতের নির্দেশ দিতেন (সুরা মারইয়াম
আয়াত ৫৫)
যাকাতের উদ্দেশ্য
তাদের মালামাল থেকে
যাকাত গ্রহন কর যাতে তুমি সেগুলোকে পবিত্র করতে এবং সেগূলোকে বারাকাতময় করতে পার এর মাধ্যমে (সুরা
তাওবাহ আয়াত ১০৩);
যাকাত বাবদ যে
আংশটা দেয়া হয় সেটা আল্লাহর নিকট পৌঁছে না । লোক
দেখানোর উদ্দেশ্যে বা লোকে মস্তবড় দাতা বলে প্রশংসা করুক বা পার্থিব কোন প্রয়োজনে
দান করলে আল্লাহ পাক কবুল করবেন না । শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দান
করলে আখেরাতে এর উত্তম বদলা পাবেন এবং ইহকালে ও তার ধন সম্পদ কখনো শেষ হবে না ।
শরী’আতের হুকুমের
গোপন রহস্য ও হিকমাত পরিপূর্ণভাবে আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না । সুতরাং শরী’আতের কোন হুকুমের রহস্য ও হিকমাত কারো
বুঝে আসুক বা না আসুক তা যে মহান আল্লাহর হুকুম এজন্য বিনা দ্বিধায় অবশ্যই পালন
করতে হবে ।
যাকাত একটি নৈতিক
ব্যবস্থাও, কেননা ধনী লোকদের মানসিকভাবে
লোভ, কার্পণ্য আত্মম্ভরিতার ময়লা ও আবর্জনা থেকে পবিত্র করা এবং বদান্যতা,
দানশীলতা ও কল্যাণ প্রেমে তাদের পরিশুদ্ধতায় ভরপুর করে দেয় । অন্য লোকদের
দুঃখ-দুর্দশায় সহানুভুতি ও দয়া মায়া সহকারে তাদের সাথে একাত্ম করে তোলে ।
বঞ্চিতদের অন্তরে যে হিংসার আগুন জ্বলে উঠে তা নিভিয়ে
দিতে যাকাত বিরাট কাজ করে ও ধনীদের সুখ
সম্পদ দেখে তাদের মনে যে কষ্ট অনুভব করে যাকাত তা প্রশমিত করে দেয় ।
যাকাত কোথায় ও কাকে দিতে হবে
এ সম্বন্ধে আল্লাহ
তা’আলা বলেনঃ সদাক্বাহ পাবার যোগ্যতা রাখে
শুধুমাত্র ফকির, মিসকীন, যাকাত সংগ্রহকারী,
যাদের অন্তরে (ইসলামের প্রতি) ঝুঁকে পড়ার
সম্ভাবনা আছে, আর ক্রীতদাস মুক্তিতে,
ঋণগ্রস্থরা, আর যারা আল্লাহ তা’আলার রাস্তায় আছে, আর রাস্তার পথিক । এটা আল্লাহর তরফ থেকে ফরয । আল্লাহ তা’আলা সমস্ত কিছু
জ্ঞাত আছেন, আর তিনি হিকমাতওয়ালা (সুরা তাওবাহ আয়াত ৬০);
এখানে ৮ ধরনের লোকের কথা বলেছেন-
১) ফকিরঃ তার যা প্রয়োজন তা তার কাছে একেবারেই নেই ।
২) মিসকীনঃ মিসকীন ফকিরের চেয়ে উত্তম । যেমন
তার প্রয়োজন ১০ টাকার আছে মাত্র ৭ টাকা । আল্লাহ বলেন-আর ঐ নৌকা যা ছিল কয়েকজন মিসকীনের,
যারা সমুদ্রে কাজ করত (সুরা কাহাফ আয়াত ৭৯)
৩) যাকাত সংগ্রহকারীঃ তারা হলেন কোন দেশের ইমাম বা তার নায়েব কর্তৃক নিযুক্ত
লোক সকল । তাদের মধ্যে আছে মাল জমাকারী, হিফাজতকারী, লেখক, হিসাব রক্ষক,
পাহারাদার, এক স্থান হতে অন্য স্থানে পরিবহনকারী এবং বিলি বন্টন করে তারাও । এদের
যাকাতের মাল দেয়া যাবে । যদি কোন ধনী লোক
স্বেচ্ছায় এ কাজে আত্মনিয়োগ করে এবং উপরোক্ত ব্যক্তির কারো জীবিন যাপনের অন্য
ব্যবস্থা থাকে তারা স্বেচ্ছায় (ইচ্ছে করলে) কিছু পারিশ্রমিক নিতে পারবেন বেতন
হিসেবে তবে তাদের যাকাত দেওয়া বা নেওয়া বৈধ নয় । আর বনু হাশেম গোত্রের হলে
যাকাত দেওয়া যাবে না । রাসুল (সাঃ) বলেছেন-নিশ্চয়ই যাকাত ও সদাক্বাহ মুহাম্মদ (সাঃ) এর বংশধরদের জন্য নয় (মুসলিম, মিশকাত
হাদিস ১৭৩১/৩)
৪) যাদের অন্তর ইসলামের দিকে ঝুঁকেছেঃ যে
সমস্ত গরীব বিধর্মী যারা ইসলাম গ্রহণ করতে
চায় বা মুসলিমদের শত্রুর হাত হতে
রক্ষা করতে চায় তাদের যাকাত দেওয়া যাবে । যেমন সফওয়া ইবনু উমাইয়াকে হুনাইন
যুদ্ধের গণীমাত দিয়েছিলেন । রাসুল (সাঃ) আবু সুফিয়ান ইবনু হারবকে দিয়েছিলেন । আক্বা
ইবনু হাবেসকেও দিয়েছিলেন । উয়াইনাহ ইবনু মিহসান কেও দিয়েছিলেন (মুসলিম)
৫) ক্রিতদাস মুক্তিতেঃ দাসদের মুক্ত করা,
যারা মুক্তির ব্যাপারে লিখে তাদের সাহায্য করা, শত্রুর হাতে বন্দী তাদেরও মুক্ত করা ইত্যাদি । এ সমস্ত কাজে যাকাতের
টাকা দিয়ে সাহায্য করা যায় ।
৬) ঋণগ্রস্থঃ যারা ঋণ করেছে এবং শোধ করার সামর্থ নেই তাদের যাকাতের টাকা
দিয়ে সাহায্য করা যাবে ।
৭) যারা আল্লাহর রাস্তায় আছেঃ যারা দীন
প্রচারের কাজে আত্মনিয়োগ করেছে-যেমনঃ কেউ কোন বিষয়ে কুরআন হাদিস সংগ্রহ করে বই আকারে বিনামূল্যে বিতরণ করে । যারা কোন রকম হাদিয়া ছাড়াই ওয়াজ নছিহত করে, কোন এতিম খানা কোন গরীব সন্তানদের মাদ্রাসায় পড়ানোর জন্য । যারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে । ইত্যাদি
ক্ষেত্রে যাকাত দেওয়া যাবে ।
৮) রাস্তার পথিকঃ ঐ মুসাফির যে এক স্থান হতে
অন্য স্থানে বা দেশ হতে অন্য দেশে গেছে কিন্তু টাকার অভাবে নিজ গৃহে যেতে পারছে না । তাকে ঐ পরিমান যাকাত দেয়া হবে
যাতে নিজের গৃহে ফিরে আসতে পারে । যদি কোথাও ধার
কর্জ পায় তবে যাকাত নিতে পারবে না । পাপের সফরে চলবে না বরং কোন ওয়াজীব
মুস্তাহাব বা মুবাহ কাজের জন্য হতে হবে ।
কতটা সাহায্য প্রয়োজন
ফকির মিসকীনদের
জন্য খানা, পোষাক, বাসস্থান এবং অন্যান্য জিনিস যা ছাড়া বাঁচা সম্ভবপর নয়, তবে কোন
অতিরিক্ত খরচ করা চলবে না । এর পরিমান নির্ধারণ করা সহজ নয় । কারণ যা এক ব্যক্তির
চলে অন্যত্র অন্য ব্যক্তির চলবে না । যা এক জনের ১০ দিনের খরচ তা অন্য কারো ১
দিনের খরচ । তবে সর্বোত্তম ব্যবস্থা
হল-অসুস্থের চিকিৎসার জন্য পুর্ণ খরচ দেওয়া, অবিবাহিতের বিবাহ খরচ দেয়া এবং যাকে
যাকাত দেয়া হয় ভবিষ্যতে যাতে আর যাকাত নিতে না হয় এরকম ব্যবস্থা করে দেওয়া ।
যেমন-কোন কর্মের ব্যবস্থা করে দেয়া । এমন কিছু দেয়া যা দ্বারা সে আয় করে জীবিকা
অর্জন করতে পারে । যেমন-রিক্সা, ভ্যান, অটোগাড়ী, গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগীর খামার
ইত্যাদি যাকাত হিসেবে দেওয়া যাতে তার আর্থিক স্বচ্ছলতা আসে ।
সাহাবীরা এমন
পরিমানে যাকাত দিতেন পরিবর্তীতে সে লোকের আর যাকাত নেওয়ার প্রয়োজন হয় নাই ।
খলীফা উমার (রাঃ) এর আমলে যাকাত বা
অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এত সুন্দর ভবে রূপায়িত হয়েছিল যে, সারা দিন ঘুরেও যাকাত নেয়ার মত লোক খুজে পাওয়া যেত না । খলিফাহ উমার বিন আব্দুল আজিজ (রাঃ) এর
সময়েও এরূপ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল । তিনি যাকাত
নেবার লোক না পেয়ে শেষে আফ্রিকা মহাদেশে গিয়ে যাকাত বন্টনের আদেশ দিয়েছিলেন ।
ইসলামের আবির্ভাবের পর হতে চার খলীফাহ ও পরবর্তী কোন কোন খলীফাহর খিলাফত কালে
যেভাবে যাকাত আদায় ও বন্টন করা হতো, বর্তমানে দুন্ইয়ার মুসলিম সরকারগুলো সরকারী ভাবে তদ্রুপ ব্যবস্থার প্রচলন করলে দুনিয়ার সকল
মুসলিমদের অবস্থাই পরিবর্তন হয়ে যেত । কিন্তু নির্মম হলেও সত্য যে আজকের মুসলিম সমাজ কুরআনের এই নির্দেশ বর্জন করে চলছে
।
আমাদের যাকাত কে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র করে অনেকের মাঝে না বিলিয়ে
আমাদের নিকটতম দরিদ্র আত্মীয় স্বজনকে বা সমাজের ফকির মিসকীনদের এমন ভাবে দিলে ভালো হবে যাতে তার আর্থিক
স্বচ্ছলতা আসে । কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় প্রতি বছরই তাদের যাকাতের জন্য
দ্বারে দ্বারে যেতে হয় এবং তাদের অভাব অন্টনের কোন পরিবর্তন হয় না ।
যাকাত দেয়া যাবে নাঃ রাসুল (সাঃ) বলেছেন-ধনী বা কর্মক্ষম যারা তাদের এতে কোন অংশ
নাই (আহমাদ, আবু দাউদ, নাসায়ী, মেশকাত হাদিস ১৭৩৮/১০)
বনু হাশেম গোত্রের
হলে যাকাত দেওয়া যাবে না ।
রাসুল (সাঃ)
বলেছেন-নিশ্চয়ই যাকাত ও সদাক্বাহ মুহাম্মদ
(সাঃ) এর বংশধরদের জন্য নয় (মুসলিম, মিশকাত হাদিস ১৭৩১/৩)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন