শুক্রবার, ১২ অক্টোবর, ২০১২

কুরবানী ও আক্বীকার কিছু মাসায়েল


কুরবানী ও আক্বীকার কিছু মাসায়েল

আমাদের মাঝে কুরবানীর ইতিহাস ইব্রাহিম আঃ এর পুত্র ইসমাঈল আঃ কে কুরবানী করার মাধ্যমে ব্যপক ভাবে প্রসিদ্ধতা লাভ করেছে । সূরা আছ-ছফফাত এর ১০০ থেকে ১১১ পর্যন্ত এর ঘটনাকে চমৎকারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে । বলা হয়েছে,
‘সে বলল, হে আমার পরওয়ারদেগার, আমাকে একটি পুত্র সন্তান দান কর । সুতরাং আমি তার ডাকে সহনশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম । অতঃপর সে যখন পিতার সাথে চলাফেরার বয়সে উপনীত হলো, তখন ইব্রাহীম তাকে বলল, বৎস, আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে যবেহ করছি । এখন তোমার অভিমত কি ? সে বলল, আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তা করুন, আমাকে সবরকারী পাবেন । যখন পিতা-পুত্র উভয়েই আনুগত্য প্রকাশ করলো এবং ইব্রাহীম তাকে যবেহ করার জন্য শায়িত করলো, তখন আমি তাকে ডেকে বললাম, হে ইব্রাহীম, তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে । আমি এভাবে সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি । নিশ্চয়ই এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা । আমি তার পরিবর্তে যবেহ করার জন্য এক মহান জন্তু (ফিদিয়া) প্রদান করলাম । আর ভবিষ্যতের জন্য ইব্রাহীমের এ সুন্নাত স্মরণীয় করে রাখলাম ।
অর্থাৎ যে ফিদিয়া বা বিনিময় দ্বারা ইসমাঈল (আ.) কে কুরবানী করা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে কিয়ামত পর্যন্ত সেই ফিদিয়ার কুরবানী চলবে । এভাবে আত্মোৎসর্গের নিদর্শনস্বরূপ কিয়ামত পর্যন্ত মুসলমানেরা আল্লাহর নামে শুধু কুরবানী করবে ।   
    কিন্তু, তার সুচনা এখান থেকেই নয় । বরং পৃথিবীর প্রথম মানব আদম আঃ থেকেই কুরবানীর ইতিহাসের সুচনা হয়েছে এবং প্রত্যেক নবী রাসুলগণের যুগেই তা বহাল ছিল । এই সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সুরাতুল হজ্জের ৩৪ নাম্বার আয়াতে বলেন 
وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكًا لِيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ 
আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যই কুরবানীর বিধাণ নির্ধারণ করেছি, যাতে করে তারা আল্লাহর দেয়া চতুষ্পদ জবেহ করার সময় তার নাম নেয় ।
        সর্বপ্রথম কুরবানী হাবিল ও কাবিলের কুরবানী
পৃথিবীর ইতিহাস যত পুরাতন কুরবানীর ইতিহাসও ততো পুরাতন । আদি পিতা আদম (আ.) এর দু' সন্তান
হাবিল ও কাবিলের কুরবানীই সর্বপ্রথম কুরবানী । সূরা মায়িদার ২৭ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন-
‘তাদেরকে আদমের দু' পুত্রের ঘটনাটি ঠিকভাবে শুনিয়ে দাও । তা হচ্ছে এই যে, তারা দু'জনই কুরবানী করলো । এক জনের কুরবানী কবুল করা হলো আরেক জনের কুরবানী কবুল করা হলো না । সে বলল, আমি তোমাকে হত্যা করবো । উত্তরে সে বলল, আল্লাহতো মুত্তাকীদের কুরবানীই কবুল করেন' ।   
        
তবে সকল সময় সকলের উপর এক রকম বিধান ছিল না । আদম (আ.)-এর যুগে কবুলকৃত কুরবানীর পশুকে উপর থেকে একটি আগুন এসে পুড়ে ফেলতো । আর কবুল না হলে যেভাবে যবেহ করেছে সেভাবেই পড়ে থাকতো । ইব্রাহীম (আ.) ও তার পরবর্তীতে কুরবানীর পশুকে যবেহ করে কাবার সামনে অথবা উপসনালয়ের সামনে রেখে দিত । বর্ণিত আছে, হযরত নূহ (আ.) জন্তু যবাই করার জন্য একটি কুরবানীগাহ নির্মাণ করেছিলেন । সেখানে তিনি জবাইকৃত জন্তু আগুন দ্বারা জ্বালিয়ে দিতেন । আরব দেশেও প্রাচীনকালে আতিয়া ও ফারা নামক দু' শ্রেণীর বলি উৎসর্গ বা এক বিশেষ ধরনের কুরবানী প্রথা চালু ছিল । রজব মাসে অনুষ্ঠিত হতো বলে এ কুরবানীকে রাজাবিয়াহও বলা হতো । যে দেবতার নামে এই বলিদান অনুষ্ঠিত হতো বলিদানের পর নিহত পশুর রক্ত তার উপর নিক্ষেপ বা লেপন করা হতো (বোখারী ও মুসলিম)
পবিত্র কুরআনে নবী করীম (সা.) কে নামায, কুরবানী করারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে । বলা হয়েছে, ‘তোমার রবের জন্য নামায পড়ো এবং
কুরবানী করো'(সূরা কাউসার-২)
     ইবরাহীম (আঃ) এর কুরবানী কেন এত স্মরণীয় এবং আমাদের কি শিক্ষণীয়ঃ-পৃথিবীর প্রথম মানব আদম (আঃ) থেকে শুরু করে এ যাবত পর্যন্ত সকল নবী রাসুলগণ, সামর্থবান ঈমানদার ব্যক্তি কুরবানী করেছেন । কিন্তু আল্লাহ ইবরাহীম (আঃ) এর কুরবানী কেন স্মরণীয় করে রাখলেন!
যখন আল্লাহ নিষ্পাপ ছেলেকে স্বপ্নের মাধ্যমে জবাই করার ওহী করলেন তখন ইব্রাহীম (আঃ) কোন রকম অজুহাত, বাহানা, হুকুম রদ করার জন্য প্রার্থনা করেননি । এমনকি মনের ভিতরে আল্লাহর হুকুমের বিপরীত কোন যুক্তি, সংশয়ের উদ্বেগ হয়নি ।
বলতে পারতেন, “হে আল্লাহ তোমার দ্বীন প্রচারের জন্য ছেলে চেয়েছিলাম । একে দ্বীনের কাজের জন্যই বেঁচে থাকতে দাও” । “আল্লাহ তোমার জন্যই আগুনে গিয়েছি, দেশ ছেড়েছি, ঘর বাড়ী, ধন-সম্পদ, আত্মীয় স্বজন সব ছেড়েছি । এ সবের বিনিময়ে আমার ছেলেটাকে কুরবানী করা থেকে রেহাই দাও” । এ সবের কিছুই তিনি বলেননি এবং মনে মনে কোন রকম চিন্তা কল্পনাও করেননি ।
কারন তিনি জানতেন “আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন । আল্লাহর ইচ্ছার বিপরিত কোন ইচ্ছা করা বা বলার কারো কোন অধিকার নেই । আল্লাহর ইচ্ছা ‘ভাল’ না ‘মন্দ’ এ চিন্তা করাও কুফরী” ।
          আল্লাহর হুকুম না মানলে কি অপরাধঃ- যখন আল্লাহ বলেছিলেন “আস্‌লিম্‌” (তুমি মুসলমান হও) অর্থাৎ আল্লাহর পুরা অনুগত হও । তখন তিনি বলেছিলেন “আসলামতু লিরাব্বিল আ’লামীন” (আমি রাব্বুল আ’লামীনের পুরা আনুগত হয়ে গেলাম)
কাজেই মুসলমান হলে আল্লাহর কোন হুকুম অমান্য করা যায় না । আর আল্লাহর কোন হুকুম অমান্য করলে মুসলমান হওয়া যায় না
ইবরাহীম (আঃ) আল্লাহর আদেশ মান্য করার জন্য তাঁর নিষ্পাপ ছেলেকে কুরবানী করতেছিল অথচ আমাদের আহাল (পরিবার, ছেলে-মেয়ে ও আপনার অনুগত অন্যান্যরা) হাজারো গুনাহর কাজে লিপ্ত (নামায পড়ে না, রোজা রাখে না, পর্দা মানে না, গান-বাজনা, বেহায়াপনা নাচ, কল্পকাহিনী নাটক সিনেমায় ব্যস্ত, মদ-জুয়া, তামাক, চুরী-ছিন্তাই ইত্যাদি হারাম কাজে লিপ্ত, জেনা-ব্যভিচারে লিপ্ত, সুদের আদান-প্রদানে করে ইত্যাদি নানা শরীয়া বিরোধী কাজে জড়িত) এসব ব্যাপারে আপনি পরিবারের অভিবাবক হিসাবে দ্বীনের জন্য কি কুরবানী করেন, কি দায়িত্ব পালন করেন ? !
                 পশু কোরবানীর সাথে পশুত্বের কোরবানী করতে হবে: ইবরাহীম (আঃ) আল্লাহর হুকুম পালনের জন্য যখন নিষ্পাপ ছেলেকে কুরবানীর জন্য শায়িত করলেন তখন আল্লাহ তার পরিবর্তে যবেহ করার জন্য এক মহান জন্তু প্রদান করেন । এখানে আল্লাহ তার বান্দার প্রতি অত্যন্ত দয়াশীল হয়েছেন । এই জন্য আমরা মুসলমানেরা প্রতি বছরে একবার পশু কুরবানী করে থাকি ।
        আমি আপনি যে পশু কুরবানী করি সে পশু কি আমাদের পার্থিব জীবনে কোন ক্ষতি করে ? উত্তরঃ ‘না’ । বরং এ গৃহপালিত পশু আমাদের নানা ধরনের উপকার করে । তাহলে এই উপকারি পশুটিকে নির্দয় নির্মমভাবে জল্লাদের মত হত্যা করা কি ঠিক হয় ? পার্থিব জ্ঞানের আলোকে উত্তর হবে ‘না’ । মানুষ মাছি এমনকি কোন ক্ষুদ্র প্রাণীও সৃষ্টি করতে পারে না । তাহলে প্রতিবছর কেন এই নিঃশংস পশু হত্যাকান্ড করা হয় ? এখানে মুসলমানেরা আল্লাহর বাণীর আলোকে উত্তর জানাবে, এটা আমাদের রবের/সৃষ্টিকর্তার হুকুম পালনের জন্য করি ।
অতএব দুনিয়ার সমস্ত লোক ইহুদী, খ্রীষ্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ তাদের অনুসারী নামধারী মুসলমান যত যুক্তি তর্কের মাধ্যমে যে কোন বিষয়ে যত কঠিন প্রশ্ন করুক না কেন দুনিয়ার জ্ঞানের আলোকে উত্তর তাদের পক্ষে হলেও বা উত্তর না দিতে পারলেও প্রকৃত মুসলমান কুরআনে বর্ণিত আল্লাহর হুকুমের বিপরিত কোন কাজ করবে না ।
     শরী’আতের হুকুমের গোপন রহস্য ও হিকমাত পরিপূর্ণভাবে আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না । সুতরাং শরী’আতের কোন হুকুমের রহস্য ও হিকমাত কারো বুঝে আসুক বা না আসুক তা যে মহান আল্লাহর হুকুম এজন্য বিনা দ্বিধায় অবশ্যই পালন করতে হবে । তাহলেই আমরা নিজেদের প্রকৃত মুসলমান বলে দাবী করতে পারব ।
     আমরা মানুষ । আমাদের মধ্যে যেমন ফেরেশতার স্বভাব আছে তেমনি পশুর স্বভাবও আছে । মানুষের মধ্যে যত ভালো গুণ রয়েছে, সেগুলো হলো-ফেরেশতার স্বভাব । আর হিংসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা, অন্যায়ভাবে কারো উপর আক্রমণ করা, মানুষের ধন-সম্পদ অবৈধভাবে দখল করা, কারো অধিকার কেড়ে নেয়া, হারাম পরিহার না করা, জেনা ব্যভিচার করা, সুদ দেওয়া-নেওয়া, পুরুষ/নারীর পর্দার বিধান মেনে না চলা ইত্যাদি হলো পশুর স্বভাব
পবিত্র কোরবানী ঈদে আমরা পশু কোরবানী করে থাকি । কুরবানীর মূল ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে এই উপলক্ষে অর্জিত তাকওয়া বা আল্লাহভীতি দ্বারা নিজের পশু স্বভাবকে কোরবানী করি না । শরিয়তের কোন বিধান মানব আর কোন বিধান আমাদের যুক্তিতে মানা সম্ভব নয় এটা ভাবলে, করলে আমাদের পশু কুরবানী এমনকি কোন ইবাদতই আল্লাহ কবুল করবে না । শুধু নামায, রোজা, হজ্জ, যাকাতের নাম ইসলাম না । এগুল পালনের পাশাপাশি আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে যত হুকুম করেছেন সবগুল পরিপূর্ণভাবে পালন করার নাম ইসলাম ।
        যদি পশু কোরবানীর সাথে সাথে আমরা নিজেদের পশুস্বভাবকেও কোরবানী করতে পারি, তবেই আমাদের সমাজ হবে সুখময়, শান্তিময় ও আনন্দময় ।
আসুন আমরা সকলে এই বছরের পশু কুরবানীর সাথে নিজের ভিতরের ও আহালের (পরিবার, ছেলে-মেয়ে ও অধিনস্থ অন্যান্য) সকলের পশু স্বভাবও কুরবানি করি । আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে হযরত ইবরাহীম (আ.) এর মহা ত্যাগের মহা স্মৃতি পবিত্র কুরবানী অনুষ্ঠান থেকে লব্ধ শিক্ষা দ্বারা আমরা যাতে নিজেদের চরিত্র গঠন করতে পারি, আল্লাহ আমাদের সেই তওফিক দিন । এটাই একমাত্র কামনা ।  
আল্লাহর রাসূল (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের আমলে মানুষ যেরূপ শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে জীবন যাপন করেছে, অনুরূপ পবিত্র স্বভাবের অধিকারী হয়ে আজও সেরূপ শান্তি ও নিরাপত্তা আমরা লাভ করতে পারি । সূরা আল হজ্বের ৩৭ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন,
‘এ কুরবানীর রক্ত ও গোশত আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না বরং তার কাছে পৌঁছে তোমাদের মনের অবস্থা বা তাকওয়া' ।


                                                                     (১ম চলবে ২য় পর্যন্ত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন