শুক্রবার, ৬ জুলাই, ২০১২

তারাবীর জন্য হাফেজ নিয়োগ প্রসঙ্গে



১৭১৪-প্রশ্ন:খতম তারাবীর ইমামতি করে বিনিময় বা হাদিয়া নেওয়া জায়েয কি না ? এক মাসের জন্য নিয়োগ দিয়ে বেতন দিলে জায়েয হবে কি না ? কেউ কেউ বলেন, ফরয নামাযের ইমামতির বিনিময় যখন জায়েয তখন খতম তারাবীর বিনিময় গ্রহণও জায়েয হবে । এছাড়া হাফেজ সাহেবকে যদি দু’এক ওয়াক্ত ফরয নামাযের দায়িত্ব দেওয়া হয় তবে তো নাজায়েয হওয়ার প্রশ্নই আসে না । তাদের একথা ঠিক কি না ? ইমামতির হীলা হোক বা অন্য কোনো উপায়ে তারাবীর বিনিময় বৈধ কি না ?

উত্তর:খতম তারাবীর বিনিময় দেওয়া-নেওয়া দুটোই নাজায়েয । হাদিয়ার নামে দিলেও জায়েয হবে না । এক মাসের জন্য নিয়োগ দিয়ে বেতন হিসাবে দিলেও জায়েয নয় । কারণ এক্ষেত্রেও প্রদেয় বেতন তারাবীহ এবং খতমের বিনিময় হওয়া স্বীকৃত । মোটকথা, খতম তারাবীর বিনিময় গ্রহণের জন্য হিলা অবলম্বন করলেও তা জায়েয হবে না । কারণ খতমে তারাবীহ খালেস একটি ইবাদত, যা নামায ও রোযার মতো ‘ইবাদতে মাকসূদা’-এর অন্তর্ভুক্ত । আর এ ধরনের ইবাদতের বিনিময় বা বেতন দেওয়া-নেওয়া উম্মতে মুসলিমার ঐকমত্যের ভিত্তিতে নাজায়েয । এতে না কোনো মাযহাবের মতপার্থক্য আছে, না পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ফকীহগণের মাঝে কোনো মতভেদ আছে ।

ইমামতির বেতন ঠিক করা এবং তা আদায় করা যদিও পরবর্তী ফকীহগণের দৃষ্টিতে জায়েয, কিন্তু খতম তারাবীর বিনিময়টা ইমামতির জন্য হয় না; বরং তা মূলত খতমের বিনিময়ে হয়ে থাকে । আর তেলাওয়াতের বিনিময় গ্রহণ করা সকল ফকীহ্ নিকট হারাম । অধিকন্তু পরবর্তী ফকীহ্গণ যে ইমামতির বেতন জায়েয বলেছেন সেটা হল ফরযের ইমামতি । সুন্নাত জামাতের ইমামতি এর অন্তর্ভুক্ত নয় ।

আর হাফেযদের দেওয়া বিনিময়কে জায়েয করার জন্য এই হিলা অবলম্বন করা যে, শুধু রমযান মাসের জন্য তার উপর দু-এক ওয়াক্ত নামাযের দায়িত্ব দেওয়া হবে-এটা একটা বাহানামাত্র; যা পরিহার করা জরুরি । কারণ এই হিলার যে বিমিনয়টা তাকে ফরযের ইমাতির জন্য দেওয়া হচ্ছে আর তারাবীর খতম সে বিনিময়হীনভাবেই করে দিচ্ছে । কিনা' আপনার মনকে একটু প্রশ্ন করে দেখুন, যদি ওই হাফেয সাহেব তার দায়িত্বে অর্পিত ফরয নামাযের ইমামতি যথাযথ গুরুত্বের সাথেও আদায় করেন আর খতম তারাবীতে অংশগ্রহণ না করেন তবে কি তাঁকে ওই বিনিময় দেওয়া হবে, যা খতম তারাবী পড়ালে দেওয়া হত ? এ কথা সুস্পষ্ট যে, কখনো তা দেওয়া হবে না । বোঝা গেল, বিনিময়টা মূলত খতম তারাবীর, ফরযের ইমামতির নয় । এ জন্যই আকাবিরের অনেকে এই হিলা প্রত্যাখ্যান করেছেন । আর দলীলের ভিত্তিতেও তাঁদের ফতওয়াই সহীহ । দেখুন: ইমদাদুল ফাতাওয়া ১/৩২২; ইমদাদুল আহকাম ১/৬৬৪

সারকথা হল, কুরআন তেলাওয়াত, বিশেষত যখন তা নামাযে পড়া হয়, একটি খালেস ইবাদত, যা একমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্যই হওয়া চাই । তাতে কোনো দুনিয়াবী উদ্দেশ্য শামিল করা গুনাহ । নিচে এ বিষয়ে কিছু হাদীস, আছারের অনুবাদ ও ফিকহের উদ্ধৃতি পেশ করা হল ।

১. হযরত আবদুর রহমান ইবনে শিবল রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, তোমরা কুরআন পড় তবে তাতে বাড়াবাড়ি করো না এবং তার প্রতি বিরূপ হয়ো না । কুরআনের বিনিময় ভক্ষণ করো না এবং এর দ্বারা সম্পদ কামনা করো না ।’-মুসনাদে আহমদ ৩/৪২৮; মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৫/২৪০; কিতাবুত তারাবীহ
 
২. ‘ইমরান ইবনে হোসাইন রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু   আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, তোমরা কুরআন পড় এবং আল্লাহ তাআলার কাছে প্রার্থনা কর । তোমাদের পরে এমন জাতি আসবে, যারা কুরআন পড়ে মানুষের কাছে প্রার্থনা করবে ।’-মুসনাদে আহমদ ৪/৪৩৭; জামে তিরমিযী ২/১১৯
 
৩. ‘হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মা’কিল রা. থেকে বর্ণিত, তিনি এক রমযান মাসে লোকদের নিয়ে তারাবীহ পড়লেন । এরপর ঈদের দিন উবাইদুল্লাহ ইবনে যিয়াদ রাহ. তাঁর কাছে এক জোড়া কাপড় এবং পাঁচশ দিরহাম পাঠালেন । তখন তিনি কাপড় জোড়া ও দিরহামগুলো এই বলে ফেরত দিলেন যে, আমরা কুরআনের বিনিময় গ্রহণ করি না ।’-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৫/২৩৭

আরো দেখুন: ফাতাওয়া শামী ৬/৫৭; তানকীহুল ফাতাওয়া হামীদিয়া ২/১৩৭-১৩৮; আলইখতিয়ার লিতা’লীলিল মুখতার ২/৬২; শিফাউল আলীল ওয়াবাল্লুল গালীল (রাসায়েলে ইবনে ইবনে আবেদীন) ১/১৫৪-১৫৫; ইমদাদুল ফাতাওয়া ১/৩১৫-৩১৯ ও ৩২২; রাফেউল ইশকালাত আনহুরমাতিল ইসি-জার আলাত্তাআত, মুফতিয়ে আযম হযরত মাওলানা মুফতী ফয়যুল্লাহ রাহ.


বিষয়টির উত্তর জানা ও সংগ্রহে রাখা খূবই জরুরী এবং আপনার মসজিদের ইমাম সাব, হাফেজ ও আলেম সমাজকে কপি প্রিন্ট করে দিতে পারেন ।



বিঃ দ্রঃ সমাধানের উপায়ঃ-

 ¤  মসজিদের ইমাম হিসাবে হাফেজ ও আলেম যোগ্যতাসম্পন্ন ইমাম নিয়োগ দিতে    পারেন ।

¤   মুয়াজ্জিন হিসাবে একজন হাফেজ নিয়োগ দিতে পারেন ।

তাহলে প্রতি রমযানে এদের দ্বারাই খতমে তারাবীর নামায পড়ানো যাবে ।

 ¤  মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিন কেউ কুরআনে হাফেজ না হলে, রমযান মাসে তারাবীর জন্য হাফেজ নিয়োগ না করে (ইমাম-মুয়াজ্জিন যা জানে তা দ্বারা) তাদের দ্বারাই তারাবীর নামায পড়াতে পারেন  

 ¤   কোন এতিম খানার হাফেজ দ্বারা খতমে তারাবী পড়াতে পারেন । তবে উক্ত হাফেজকে কোন রকম হাদিয়া নেওয়া বা দেওয়া যাবে না ।

¤ এতিম খানা পরিচালকের নিকট তারাবীর বিনিময় না ভাবিয়া প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য বাৎসরিকভাবে প্রতি বছর নির্দিষ্ট অংকের হাদিয়া দিতে পারেন যা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার কাজে ব্যয় করবেন ।

¤ পরিচালক সেখান থেকে উক্ত হাফেজকে একটি টাকা এমনকি কোন পোষাক, লেখা পড়ার সামগ্রি কিনে দিতে পারবে না । অর্থাৎ হাফেজকে কোনভাবেই এ টাকার অংশ দেয়া যাবে না

এভাবে কুরআন-হাদিসের আলোকে সহিহ হতে পারে ।                     

এছাড়া সমাধানের আর কোন পদ্ধতি বা নিয়ম অবলম্বন করা যায় কিনা তা আপনারা নিরপেক্ষভাবে সুষ্ঠু শান্ত মস্তিষ্কে চিন্তা করুন ।

আল্লাহ আমাদের সকলকে সহিহ দ্বীন বুঝার তাওফিক দিন ।
আমীন!!

৯টি মন্তব্য:

  1. আপনারা আপনাদের সমাজের ইমামকে কপি করে দিতে পারেন ।

    উত্তরমুছুন
  2. উত্তরগুলি
    1. আপনার প্রশ্নের উত্তর পরিচিত কোন আলেমের থেকে লিখিত চাইতে পারেন ।
      প্রশ্ন গুল কি জানান । উত্তর জানানোর চেষ্টা করব । ইনশাআল্লাহ!

      মুছুন
  3. কুরআন শিক্ষা দিয়ে, ইমামতি করে, আযান দিয়ে, দ্বীনী তা‘লীম দিয়ে বিনিময় গ্রহণ করা জায়েয আছে। তবে অর্থ গ্রহণ যেন উদ্দেশ্য না হয়। উদ্দেশ্য হতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি। কারণ রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, যে বস্ত্তর উপর তোমরা পারিশ্রমিক গ্রহণ করবে সেগুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশী হকদার হচ্ছে আল্লাহ্র কিতাব (বুখারী, মিশকাত হা/২৯৮৫)। উক্ত হাদীছে সূরা ফাতিহা পাঠ করে ঝাড়ফুঁক করে ছাহাবীগণ খাদ্য হিসাবে বিনিময় গ্রহণ করেছেন সে কথাও উল্লেখ রয়েছে।
    রাসূল (ছাঃ) আবূ মাহ্যূরাকে আযান শেষে একটি রূপার থলি প্রদান করে তার জন্য বরকত কামনা করে দো‘আ করেন (নাসাঈ হা/৬৩২; ইবনু মাজাহ হা/৭০৮)। অন্য হাদীছে রাসূল (ছাঃ) আযানের বিনিময়ে যে পারিশ্রমিক গ্রহণ করবে না তাকে মুয়াযযিন হিসাবে গ্রহণ করতে বলেছেন (নাসাঈ হা/৬৭২; তিরমিযী হা/২০৯)। এর অর্থ হচ্ছে, যে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ গ্রহণ করার শর্ত দিবে। যেমন বলল, এ পরিমাণ টাকা না দিলে আমি ইমামাতি করব না, আযান দিব না, কুরআন পড়াবো না। কিন্তু কর্তৃপক্ষ নিজেদের ইচ্ছায় প্রদান করলে তাতে কোন দোষ নেই (শানক্বীত্বী, শারহু যাদুল মুসতাক্বনি‘ ৯/১৪৯)।
    এগুলিতে বিনিময় গ্রহণ করা কুরআনকে স্বল্প মূল্যে বিক্রয়ের অন্তর্ভুক্ত বিষয় নয়। ইহুদী-নাছারা ধর্মনেতারা তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তাদের কিতাবের শব্দ বা অর্থ পরিবর্তন করে ফেলত এবং তার বিনিময়ে লোকদের নিকট থেকে অর্থ উপার্জন করত। আল্লাহ একে তাচ্ছিল্যভরে ‘স্বল্পমূল্যে বিক্রয়’ বলে অভিহিত করেছেন(তাফসীর কুরতুবী, উক্ত আয়াতের বাখ্যা দ্রঃ)। অতএব ইসলামী শারী‘আতের কোন বিধানকে পরিবর্তন করার লক্ষ্যে যদি কেউ ঘুষের মাধ্যমে অর্থ গ্রহণ করে তাহলে তা এ আয়াতের অন্তর্ভুক্ত হবে।

    http://www.at-tahreek.com/June2012/15.html

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. আপনার কমেন্টে মসজিদের ইমাম, মোয়াজ্জিন, মাদ্রাসার শিক্ষকের কথা বলেছেন যা যায়েজ ।
      কিন্তু খতম তারাবির জন্য ভাড়া করে হাফেজ আনতে হবে এটা যায়েজ কিনা বলেন নি !!!

      মুছুন
  4. উত্তরগুলি
    1. আপনার লেখা ও ঐ একই অবস্থা হাফেজ কন্টাক করে খতম তারাবী পড়ানো যায়েজ কিনা এটা নাই !!!

      মুছুন
  5. যেহেতু খতমে তারাবীহ পড়ে হাফেজ কে টাকা না দিলে পরের বছর আর হাফেজ পাওয়া যাবে না, অপর দিকে ‎হাফেজকে টাকা দেয়াও জায়েজ নেই তাই এক্ষেত্রে আল্লামা আব্দুর রহীম লাজপুরী (রঃ) একটি পন্থা বাতলে দিয়েছেন ‎তা হলো-‎
    রামাযানে হাফেজকে নিয়োগ দেয়ার সময় এক মাসের জন্য সহকারী ইমাম হিসেবে নিয়োগ দিবে এবং হাফেজকে ‎প্রতিদিন মসজিদে তারাবীহ ছাড়াও এক দুই ওয়াক্তের ইমামতির দায়িত্ব দিবে এবং ইমামতির উপর ভিত্তি করে তাকে ‎হাদিয়া দেয়া হবে। যেহেতু ইমামতি করিয়ে টাকা দেয়া জায়েজ।
    মুফতী কেফায়াতুল্লাহ (রঃ) ও মুফতী মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী (রঃ)ও এ কৌশলটিকে জায়েজ বলেছেন। (ফাতোয়ায়ে ‎রহীমিয়া-৬/২৩৫/২৪৬)‎

    উত্তরমুছুন
  6. ৩. ‘হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মা’কিল রা. বর্ণিত এই হাদিসটির কথা তাফসীরে রুহুল মাআনিতে বিশুদ্ধ বলেননি। তাছাড়া একজন সাহাবির আমল দ্বারা খবরে মাশহুরের উপর দলিল সাব্যস্ত করা যায়না। মূলত িএই হাদিয়া ছিল ঘুষ। যে কারণ সাহবি গ্রহণ করেননি।

    উত্তরমুছুন